পদ্মা সেতু শুরুর ইতিহাস
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, নিন্দুকদের সমালোচনা এবং সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে পদ্মা সেতু চালুর জন্য এখন শুধু অপেক্ষা ক্ষণ গণনার।
তবে, এটা শুধুই সেতু নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের সমগ্র মানুষের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী পদক্ষেপ, দৃঢ় মনোবল, সঠিক দিক নির্দেশনা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতু আজ সগৌরবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ বৃহৎ কর্মযজ্ঞের যাত্রাটা মোটেই মসৃণ ছিল না। সেতু নির্মাণে পাড়ি দিতে হয় বন্ধুর পথ। এর শুরু থেকেই চলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এ কর্মযজ্ঞের মাঝেও আসে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এমনকি সেতু নিয়ে ছড়ানো হয় গুজবও। সব কিছু ছাপিয়ে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা।
মূলত, অবহেলিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। আর এক্ষেত্রে শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ছাড়াও বিবেচনা করা হয় আরো ৩টি স্থানকে। তবে শেষ পর্যন্ত দূরত্ব, ভৌত ও কারিগরি, অর্থনৈতিক, স্থানীয় অবকাঠামো, সম্ভাব্যতা, আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তেই নির্ধারণ করা পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান।
আর এ লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেন। এবং এ সরকারের আমলেই প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলেও সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কোনো এক অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় পদ্মা সেতু প্রকল্প। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকল্পটি একনেকে পাশ হয়।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকার আবারো ক্ষমতায় এসে সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। পদ্মা সেতুর নকশা করে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএম। যদিও ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি রেলপথ সংযুক্ত করে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ।
সেতু নির্মাণে প্রথমে অর্থের যোগানদাতা হিসেবে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অঙ্গীকার করলেও দুর্নীতির বায়বীয় অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে সংস্থাটি সরে যায়। মূল ঋণদাতা সংস্থা চলে যাওয়ার সাথে সাথে একে একে চলে যায় এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও। কিন্তু যে জাতি বীরের জাতি, যারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। তাদেরকি আর দাবিয়ে রাখা যায়। তাইতো নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। মূল সেতুর নির্মাণকাজের দায়িত্ব পায় চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। পাইলিং ও পিলারের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর অবশেষে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। যা সেতুকে এপারের সাথে ওপারে সংযুক্ত করতে মূল কাঠামো হিসেবে কাজ করবে। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়।
এভাবেই একে একে ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। আর শেষ স্প্যানটি বসানো হয় ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ তম পিলারে। যার মাধ্যমে সেতুর বন্ধনে যুক্ত হয় এপার ওপার। দেশের অবহেলিত সেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যুক্ত হয় রাজধানী ঢাকার সাথে। এরপর চূড়ান্তভাবে সেতুতে যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয় পদ্মা বহুমুখী সেতু। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সৃষ্টি করে এক অনবদ্য ইতিহাস।