দেশের নদীগুলো একের পর এক খুন হয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের নদীমুখে বাঁধ, নদীকেন্দ্রিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং স্থানীয় দখলদারেরা প্রধানত দায়ী বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ সংগঠক আনু মুহাম্মদ।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, নোঙর, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও ইনিশিয়েটিভ ফর পিসের যৌথ আয়োজনে ‘দখলের গ্রাসে শুঁটকি নদীর ২৬ কিলোমিটার, ৫০ বছরের নদী লুট ঠেকাতে নাগরিক আহ্বান’- শীর্ষক সভায় এসব কথা জানান তিনি।
আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের নদীগুলো যে একটার পর একটা খুন হয়ে যাচ্ছে এর পেছনে তিনটা উৎস। প্রথমত, ভারত- সেখানে বাঁধ, নদী সংযোগ প্রকল্প হওয়ার কারণে আমাদের নদীগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নদী সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প। এর ফলে প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, অপরিকল্পিত কাজের কারণে সীমানা অনির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের সঙ্গে অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, সংস্থা ঋণ দিচ্ছে। তৃতীয় হচ্ছে, যারা সরাসরি নদী দখল করছে। এটা সরাসরি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত।
বর্তমানে যে উন্নয়নের মডেল তা নদী খুনের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির পেছনে কন্সট্রাকশন অন্যতম বড় খাত। এই খাতের সঙ্গে জড়িত ইট, সিমেন্ট, বালি। এসবের সঙ্গে সরাসরি নদী সম্পর্কিত। শুঁটকি নদী দখল করে দেওয়ান ইয়াহিয়া কন্সট্রাকশন করছেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পাড়ে সিমেন্ট কারখানা, ইটের ভাটা। উন্নয়ন বলতে যদি শুধু জিডিপি বোঝেন তাহলে তো নদী দখল খুবই ভাল কাজ।
নদী কেটে সরু করতে তিনটি বড় প্রকল্প হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, চীন তিস্তা নদীতে বিনিয়োগ করছে। বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগে ব্রহ্মপুত্রে আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে। ভারতের বিনিয়োগে আরও কয়েকটি নদীতে আরেকটি হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলোর মূল কথা হচ্ছে- নদী কেটে সরু বানাতে হবে যেন নদীর পাড়ে জমি বের করা যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের সামগ্রিক নদী প্রশাসনের চিত্রটা খুব ঘোলাটে। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ তাদের নদী রক্ষা করেছে তারা নদীকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছে। একটা নৃতাত্ত্বিক কারণেই নদী রক্ষা করতে হবে।
নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, দলমত নির্বিশেষে নদী সবার। তাই, এটা আমাদের সবার রক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ বলছে না, নদী উদ্ধার চাই। তাদেরও বলা উচিত। এমন কোনো বড় প্রতিষ্ঠান নেই যারা গত ৩০ বছরে নদী দখল করেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই নদী দখল হচ্ছে। নদী, পানি, পরিবেশ, দেশের অস্তিত্ব ও আগামী প্রজন্মের স্বার্থে সকল নদী দখলমুক্ত করতে হবে।
সভায় অন্যান্য বক্তারা বলেন, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার শুঁটকি নদীকে খাল দেখিয়ে ইয়াহিয়া ফিশারিজ প্রাইভেট লিমিটেড আদালত ও স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে প্রায় ৫০ বছর ধরে ভোগদখল করছে। নদীটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকাভুক্ত হলেও দখলদারের তালিকায় ইয়াহিয়া ফিশারিজ বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান আহমেদ রাজার নাম কোথাও নেই। নদীতে স্থানীয় মাঝিরা মাছ ধরতে গেলে তিনি বন্দুক হাতে তেড়ে আসেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নির্বাহী শিপা হাফিজা, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. আনিসুজ্জামান, নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস প্রমুখ।