সলামে নেতৃত্ব একটি কঠিন জবাবদিহিতামূলক বিষয়। নেতৃত্বে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন নবী-রাসুলরা। কেননা তারা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত ও প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ছিলেন। আল্লাহ বিশ্বজাহানের মালিক। তিনি এর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষকেই। তাই মানুষকে ‘খলিফা’ বা প্রতিনিধি বলা হয়। আর জনপ্রতিনিধিকে বলা হয় ‘খলিফাতুন নাস’, নেতা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘ইমাম’। সেই অর্থে দেশ ও জাতির নেতৃস্থানীয় প্রত্যেক ব্যক্তিই একেক জন ইমাম। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানিয়েছেন।’ (সুরা ফাতির: ৩৯)। তবে যে কেউ চাইলেই নেতা হতে পারে না। ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় নেতৃত্বে যাওয়া সম্ভব হয় না। এর জন্য কিছু গুণাবলী প্রয়োজন, অর্জন করতে হয় যোগ্যতা। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যোগ্য নেতা বা নেতার গুণাবলী নিচে তুলে ধরা হলো।
প্রাপ্তবয়স্ক বা পূর্ণবয়স হওয়া
কোনো ব্যক্তি নেতা হতে চাইলে বা নেতৃত্বে আসতে চাইলে প্রথমই তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া জরুরি। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স বা মানসিক বিকারগ্রস্ত বা জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা নেতৃত্বের যোগ্য হতে পারে না। এই সম্পর্কে সুরা নিসার ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের ধন-সম্পদ দিয়ো না, যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্য করেছেন জীবিকার মাধ্যম।’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করা হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক, যতক্ষণ না সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়। পাগল, যতক্ষণ না সে জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়।’ (নাসায়ি)
ন্যায়পরায়ণ হওয়া
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা একজন ইমাম বা নেতার প্রধান কর্তব্য। নেতা কোনো অবস্থায়ই তার অধীনস্থ লোকদের মধ্যে বৈষম্য করবেন না। সবার সঙ্গে ইনসাফভিত্তিক আচরণ করবেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতীয়তা বা অঞ্চল নির্বিশেষে সবাই নেতার কাছ থেকে ইনসাফ পাবেন। সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ন্যায়বিচারে তোমরা অটল থেকো, আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকারীরূপে যদিও নিজেদের প্রতিকূলে যায় অথবা বাবা-মা ও নিকটাত্মীয়দের, সে ধনী বা গরিব হোক, আল্লাহই উভয়ের জন্য উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে নিজ নিজ খেয়ালখুশির (পক্ষপাতিত্বের) বশীভূত হইয়ো না।’
যোগ্য হওয়া
নেতাদের একা একা অনেক ধরনের পরিকল্পনা সাজাতে হয়। পরে তা ছড়িয়ে দিতে হয় দলের সবার মধ্যে। অনেক সময় দেখা যায়, বৃহৎ স্বার্থে দারুণ একটি পরিকল্পনা থেকে সরে আসারও প্রয়োজন পড়ে। তাই যদি প্রকৃত নেতা হতে চান তাহলে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। এটি জনপ্রতিনিধির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আলী (রা.) বলেন, ‘মানুষের নেতৃত্বদানের অধিকারী হবে সে, যে তাদের সবার তুলনায় অধিক দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও অধিক শক্তিশালী হবে।’ সায়িদ হাভি বলেন, ‘জনপ্রতিনিধির জন্য শর্ত হলো, তাকে অবশ্যই জনগণের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য হতে হবে।’ (আল-ইসলাম: ২ / ১৪৮)
সুস্থ হওয়া
সুস্থতা আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত। শরীর সুস্থ থাকলে যে কোনো কাজেই মন বসে। নেতা হওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হওয়া নেতা হওয়ার অন্যতম শর্ত। কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে পড়েন। যেমন অন্ধ, বধির, বোবা ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সুরা বাকারার ২৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও দেহে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
আইনে পারদর্শী
একজন জনপ্রতিনিধি বা নেতার রাষ্ট্রের আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী হতে হবে। ইসলামি রাষ্ট্র হলে আল্লাহর আইন সম্পর্কে পারদর্শী হতে হবে। সমাজের অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের মতো জনপ্রতিনিধিও সমভাবে আইনের আওতায় থাকবেন। (অভিযুক্ত হলে তাকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ থাকতে হবে। ইসলামে জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা ও কার্যাবলি লাগামবদ্ধ করা হয়েছে।) সায়িদ হাভি বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া সর্বপ্রথম আবশ্যক। কেননা, তিনি তার রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন করে থাকেন।’ (আল-ইসলাম: ২/১৪৮)।
আদর্শিক হওয়া
চরিত্র বা আদর্শের জায়গার থেকে একজন নেতাকে অবশ্যই আদর্শিক হতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম হলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)। তার চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিচ্ছেন- আর নিশ্চয় আপনি মহৎ চরিত্রের ওপর রয়েছেন।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিচ্ছ আর নিজদের বেলায় ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করো। তোমরা কি বোঝো না?’ (সুরা বাকারা: ৪৪)।
তিনি আরও বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা তা কেন বলো, যা তোমরা নিজেরা করো না? তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধের বিষয়।’ (সুরা সফ: ২-৩)।
মানবিক হওয়া
নেতারা উদার, মহৎ, ক্ষমাশীল ও মানবিক হবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! এটা আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহের বিষয় যে, আপনি এসব লোকের জন্য খুবই নম্র স্বভাবের হয়েছেন। আপনি যদি উগ্র স্বভাব ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তবে এসব লোক আপনার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেত, অতএব তাদের ক্ষমা করে দিন। তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করুন এবং ইসলামের কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অবশ্য কোনো বিষয়ে আপনার মতো সুদৃঢ় হয়ে গেলে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। বস্তুত আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তার ওপর ভরসা করে কাজ করে। (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৫৯)। সুরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি।’
অর্থ বা পদের মোহ না থাকা
জনগণের রায়ের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকে। তিনি ওই পদ পাওয়ার জন্য কারও দ্বারস্থ হবেন না অথবা পদের মোহে অর্থ খরচ করবেন না। এমন করলে তা তার অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। এমনকি তিনি যখন জনগণের রায়ে নির্বাচিত হবেন, তখনো আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছ থাকবেন এবং অনিয়ম করবেন না, যার দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ বা এ-জাতীয় কোনো দোষ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
জন্মসূত্রের পবিত্রতা
জনপ্রতিনিধিকে অবশ্যই জন্মসূত্রে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারের পথ বন্ধ করার জন্য এমন শর্তারোপ করা হয়েছে। ব্যভিচারপ্রসূত ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রের উচ্চতর আসনে বসানো হয়, তাহলে তা গোটা জাতির জন্য কলঙ্কের বিষয়। ফলে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সেই জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহর ওপর ভরসা করা
জীবনের প্রতিটি কাজের জন্য অবশ্যই আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া ইসলামের বিধান। সেই অর্থে জনপ্রতিনিধিকে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কেননা আল্লাহ ছাড়া কারও ওপর ভরসা করা তার জন্য সমীচীন নয়। কাজে-কর্মে আল্লাহর ওপর ভরসা ও তার কাছে সাহায্য কামনা করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘এরপর (সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর) যখন সংকল্প করবে, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করবে।’ (সুরা আল ইমরান: ১৫৯)।