সিটি কর্পোরেশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী কোনো মেয়র লাভজনক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও আইন উপেক্ষা করে মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সত্য বিদায়ী মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। আর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সব লেনদেন হত এই ব্যাংকের মাধ্যমেই।
ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মধুমতি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। সেই সুবাদে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এফডিআর, ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্স, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থসহ নানা সিটি ফির টাকা সেই ব্যাংকেই রাখতেন।
এই ব্যাংকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫০০ কোটি টাকা আমানত হিসেবে জমা রয়েছে। এছাড়া শাহবাগ শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজের ৬০৩ কোটি টাকা, চারটি খাল উন্নয়ন প্রকল্পের ৮৭৬ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুই হাজার কোটি টাকা এই ব্যাংকে জমা রেখেছেন মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২০ সালের ১২ মে মধুমতি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এরপর থেকেই ডিএসসিসির মধুমতি ব্যাংকের সঙ্গে সব লেনদেন করতে হয়। এরমধ্যে আছে ডিএসসিসির সব ধরনের আর্থিক ফান্ড জমা রাখাসহ হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ সব ধরনের আর্থিক লেনদেন।
সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশনা অনুযায়ী হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকাও সরাসরি আদায় করে মধুমতি ব্যাংক। সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আসে এই ব্যাংকের মাধ্যমে, যার নির্দেশনা সরাসরি দেওয়া ছিল সদ্য বিদায়ী মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের পক্ষ থেকে। তার নির্দেশেই নগর ভবনের ৮ তলায় একটি রুম ওই ব্যাংকের বুথের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে সিটি কর্পোরেশন কোনো ভাড়া পায় না।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব, সম্পত্তি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে তারা কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক মেয়র যেহেতু ওই ব্যাংকের একজন পরিচালক, মালিকানাও আছে। তাই উনি মেয়র হিসেবে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ওই ব্যাংকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সব আর্থিক লেনদেন করতেন। আমাদের কাউকেই কিছুই এ বিষয়ে বলার সুযোগ রাখেননি তিনি। বাধ্য হয়ে আমরা সার্বিক বিষয়গুলো মেনে নিয়েছিলাম। তবে এখন সময় এসেছে এসব বিষয়ের সঠিক সমাধান হওয়ার।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলরাও লাপাত্তা হয়েছেন। তারা অফিস করছেন না। কারণ তারা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। ফলে দুই সিটির সেবা কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। দুই সিটির ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৮ জন বিএনপিপন্থি। ওই ১৮ জন ছাড়া অন্য কোনো কাউন্সিলর অফিস করছেন না।
যার প্রভাব পড়েছে সিটি কর্পোরেশনের পরিষেবায়। বর্তমানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে দুজন প্রশাসক দায়িত্ব পালন করছেন।
গেল কোটা সংস্কার আন্দোলনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। গত ৩ জুলাই ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বিমানের ফ্লাইটে একাই সিঙ্গাপুরে গেছেন। তার সঙ্গে তার পরিবারের কোনো সদস্য ছিলেন না।
এদিকে ঢাকার দুই মেয়রের পাশাপাশি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশিরভাগ কাউন্সিলরের মধ্যে অনেকে হয় দেশ ছেড়েছেন, নয়তো গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে অবস্থান নিয়েছেন। দুই সিটির ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৫৪ কাউন্সিলর গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে। তারা কেউই অফিস করছেন না। ফলে নাগরিক সেবা নিতে এসে সিটি কর্পোরেশন কার্যালয় থেকে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ নাগরিকরা। এছাড়াও মশক নিধন কার্যক্রম, পরিচ্ছন্না কার্যক্রমসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা জাতীয় কাজগুলোতেও ছন্দপতন ঘটেছে। তবে দুই সিটির এই ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৮ জন বিএনপিপন্থি কাউন্সিলর তাদের কার্যক্রমগুলো পরিচালনার পাশাপাশি অফিসও করছেন বলে জানা গেছে।