সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা । সড়কে যেকোনো আইন লঙ্ঘন করলেই গুনতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা, কারাদণ্ড এমনকি হতেও পারে উভয় দণ্ড । জরিমানা হতে পারে পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর কারাদণ্ড এক মাস থেকে পাঁচ বছর। বড় দণ্ডসংবলিত নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হচ্ছে আজ শুক্রবার থেকে। সময় এসেছে এখন যানবাহনের চালক ও মালিকদের এবার আরও সতর্ক হওয়ার ।
এত দিন মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং মোটরযান বিধিমালা ১৯৮৪-এর অধীনে সড়ক পরিবহন খাত পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১লা নভেম্বর থেকে আগের আইন ও বিধি অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। তবে নতুন আইনের বিধি এখনো তৈরি করতে পারেনি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। খসড়া বিধিতে ঘষামাজা চলছে। নতুন আইন, বিপুল পরিবর্তন সত্ত্বেও তা জনগণ ও পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের জানাতে সরকারের তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়নি।
২০১৬ সালের হিসাব ধরে গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ তৃতীয়।
আইন প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বেশির ভাগ ধারার জরিমানা ১০ থেকে ৫০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিছু কিছু ধারায় তা এক হাজার গুণ বেড়েছে। আগে যেসব ধারায় তিন মাস কারাদণ্ডের বিধান ছিল, এখন তা তিন বছর পর্যন্ত হয়েছে।আইনের বেশির ভাগ ধারাতেই সর্বোচ্চ শাস্তি কত হবে তা আছে, সর্বনিম্ন শাস্তির উল্লেখ নেই। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নির্বাহী হাকিমেরা সড়কে কোন অপরাধের জন্য কী পরিমাণ জরিমানা করবেন—এ নিয়ে কিছুটা জটিলতার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা একই অপরাধে একেক পরিমাণ জরিমানা করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে এটি কার্যকর করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়।
নতুন আইনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে শাস্তির বিধান। এই অপরাধে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে তদন্তে প্রমাণিত হলে ফৌজদারি আইনের ৩০২ ধারায় মামলা স্থানান্তর হবে। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের সুযোগ থাকছে। এই ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য। পুরোনো আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড এবং এটি জামিনযোগ্য অপরাধ।
এ ছাড়া অতিরিক্ত মালবোঝাই ও নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন চালিয়ে দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদের হানি করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। অথবা তিন লাখ টাকার জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পুরোনো আইনে এই অপরাধ কয়েকটি ধারায় বিভক্ত ছিল। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
নতুন আইন সম্পর্কে মতামত জানাতে গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। মামলা তদন্তে পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (এআরআই) সম্পৃক্ত করার দাবি জানান তিনি। শাজাহান খান বলেন, বিধি প্রণয়ন না করেই আইন প্রয়োগে জটিলতা হতে পারে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সাজার ধারা জামিনযোগ্য করা এবং ৩০২ ধারায় মামলা স্থানান্তর না করার দাবি জানান তিনি।
নতুন আইনে যা যা রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পুরোনো আইনে এ অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ সাজা চার মাসের কারাদণ্ড, বা ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
যাত্রীবাহী বাসের কন্ডাক্টরদের (ভাড়া আদায়কারী) লাইসেন্স না থাকলে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে নিবন্ধন সনদ না নিয়ে রাস্তায় যানবাহন নামালে এর মালিককে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। ভুয়া নম্বরপ্লেট দিয়ে যানবাহন চালালে সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
দেশে এখনো প্রায় পাঁচ লাখ যানবাহন ফিটনেস সনদ ছাড়া চলছে। নতুন আইনে ফিটনেসবিহীন যান চালানোর দায়ে সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ হাজার টাকা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড। অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দেশে যানবাহন আছে প্রায় ৪০ লাখ। চালক আছেন ২৩ থেকে ২৪ লাখ। বাকি ১৬ থেকে ১৭ লাখ যানবাহনের চালকের লাইসেন্স নেই অথবা ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে চালান। নতুন আইনে ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের শাস্তি কমপক্ষে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আইনে প্রত্যেক চালকের জন্য ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নানা অপরাধে পয়েন্ট কাটা গিয়ে শূন্য হয়ে গেলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় নৈমিত্তিক ব্যাপার। ভাড়ার তালিকা না থাকলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা এক মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে এটি চালকের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাঁর এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
যত্রতত্র হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর অপরাধে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। নতুন আইনে এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
যানবাহনচালককে যেমন সংকেত মেনে চলতে হবে, তেমনি পথচারীকে সড়ক-মহাসড়কে জেব্রা ক্রসিং, পদচারী-সেতু, পাতালপথসহ নির্ধারিত স্থান দিয়ে পার হতে হবে।এর ব্যতিক্রম হলে চালক ও পথচারীকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে পড়তে হবে।
অনলাইন নিউজ ডেস্ক / বিজয় টিভি