চলনবিল অধ্যষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশে পানি কমে মাছের সংকট দেখা দেওয়ায় বিল অঞ্চলগুলোতে অবাধে চলছে শামুক-ঝিনুক নিধন। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা প্রতিদিন বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করে বিক্রি করছে।
উন্মুক্ত জলাশয়ের প্রাকৃতিক ফিলটার হিসেবে পরিচিত এসব জলজ প্রাণী নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। ছোট ও মাঝারীসহ বিভিন্ন প্রকারের শামুক হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে প্রতিদিন ৭০-৮০টি ট্রাক শামুক নিয়ে বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ, সগুনা, মাগুড়া বিনোদ, বারুহাস, ইউনিয়নের ছোট ছোট নদী, খাল, বিল ও ডোবা থেকে ছোট ও মাঝারী শামুক ধরছে স্থানীয়রা। জলাশয়ের পানি কম থাকায় খুব সহজেই শামুক ধরছেন তারা। এদিকে, পানি কমে যাওয়ায় চলনবিলে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা মাছ না পাওয়ায় শামুক ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলনবিলের শামুক হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। স্থানীয় খামারিদের চাহিদা মিটিয়ে খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, বরিশাল, বাগেরহাট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খামারিদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এই চলনবিলের শামুক ও ঝিনুক।
তাড়াশের নওগাঁ গ্রামের সিদ্দিক হোসেন, রফিক সরকার, রবি ও ইয়াসিনসহ অনেক মৎস্য চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের মতো বিল অঞ্চলের বহু মানুষের সংসার চলে মাছ ধরে। কিন্তু এ বছর ভরা বর্ষায়ও বিলে পানি কম। অল্প পানিতে মাছের দেখা মিলছে না। বাধ্য হয়ে শামুক ধরে বিক্রি করছেন তারা।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, বিলের শামুক ধরতে ভোর রাতে বেরিয়ে পড়েন মৎস্য চাষিরা। দুই থেকে তিনজন মই জাল টেনে দুপুরের মধ্যেই এক নৌকা শামুক সংগ্রহ করেন।
উপজেলার কামারশন গ্রাম এলাকার তাড়াশ-গুরুদাসপুর সড়কের পাশেই চলছে শামুক বেচা-কেনা। শ্যালো মেশিনের নৌকায় শামুক ভরে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন মৎস্য চাষিরা।
মাসুদ, মিজান, মেহেদী ও শাহিন নামে চারজন শামুক সংগ্রহকারী জানান, বর্ষার সময়েও চলনবিলে পানি কম থাকায় মাছের সংকটে আমরা শামুক সংগ্রহ করছি। একজন প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বস্তা শামুক সংগ্রহ করেন। প্রতি বস্তা শামুক বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। মই জাল দিয়ে রাতভর শামুক ধরে সকালে ঘাটে বিক্রি করি। এভাবে প্রত্যেকের ৫০০-৭০০ টাকা উপার্জন হয়। এভাবেই আমরা জীবন নির্বাহ করে যাচ্ছি।
স্থানীয় শামুক ব্যাপারী আব্দুল কাদের বলেন, প্রতিদিন কামারশন ও কুন্দইল ঘাটের দুই থেকে আড়াই হাজার বস্তা শামুক কিনে থাকেন। অনরূপভাবে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের পাশে ও নাদো সৈয়দপুর খেয়াঘাটসহ বিল অঞ্চলের বেশ কয়েকটি স্থানে শামুক বেচা-কেনা হচ্ছে।
বরিশালে এক হাঁস খামারি আলম শেখ জানান, ৩৫০-৪০০ টাকায় এক বস্তা শামুক পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে এক বস্তা হাঁসের খাবার কিনতে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা গুণতে হয়। তাছাড়া শামুক খাওয়ালে হাঁস বেশিদিন ডিম দেয় এবং মাংস বৃদ্ধি পায়।
তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক ভাবে শামুক পানি পরিষ্কার করে। যা মাছসহ অধিকাংশ জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে শামুক নিধন হলে চলনবিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং কমে যাচ্ছে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তিও এবং ফসলহানির আশঙ্কাও রয়েছে।
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল করিম বলেন, চলনবিল অঞ্চলে মাছের পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভাবেই ব্যাপক শামুক উৎপাদন হয়। প্রয়োজনে শামুক সংগ্রহ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাং কুমার তালুকদার বলেন, বন্য প্রাণী নিধনে শাস্তির কথা বলা হলেও শামুক নিধনে সুনির্দিষ্ট করে শাস্তির কথা উল্লেখ নেই। ফলে শামুক নিধন বন্ধে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বললে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এখনই শামুক নিধন বন্ধ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা না গেলে আগামীতে বিলাঞ্চল থেকে শামুকের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। এমন আশঙ্কা করছেন এলাকার সচেতন মহল।