ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার সূচনা সম্ভব হতো না যদি ১৯৬৪ সালে এই অঞ্চলের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো: হানিফউদ্দিন মিয়া তা শুরু না করতেন। সে দিন একটি মাত্র আইভিএম ১৬২০ মডেলের কম্পিউটার থেকে হানিফ মিয়ার হাত ধরে একটি কমিউনিটির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কম্পিউটার। তিনি হানিফ উদ্দিন মিয়াকে কম্পিউটার বিপ্লবের জাতীয় বীর আখ্যায়িত করে তার জীবনী পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানান।
আজ (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় ডাক অধিদপ্তর মিলনায়তনে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া স্মরণে বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তর কর্তৃক স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে হানিফ উদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম এবং তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শরীফ হাসান উপস্থিত ছিলেন।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে আজ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এখনও অনেকে জানেন না যে, বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার কে ।এমনকি যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে তারাও জানে না যে কার হাত ধরে ’৬৪ সালে আমরা কম্পিউটারের যুগে পা ফেলেছিলাম।
মানুষটি যেমনি বিস্মৃত তেমনি ঘটনাটিও। তিনি বলেন, ৯৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম আমাকে কম্পিউটার বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করার অনুমতি প্রদান করে। আমি ’৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই হানিফউদ্দিন মিয়ার সাক্ষাৎকার দিয়ে।সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশের কম্পিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইলফলক। কারণ হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এ দেশে কম্পিউটার আসার কথা। তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কম্পিউটারটি পাই।
বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো: আজিজুল ইসলামের সভাপত্বিত্বে অনুষ্ঠানে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক এসএস ভদ্র বক্তৃতা করেন।
বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের কৃতীসন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষক পিতা রজব আলী তালুকদারের দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন, চেকোশ্লোাভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে অ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি [যুক্তরাষ্ট্র] কম্পিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় প্রোগ্রামার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইমপ্লিমেশন অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্তবিষয়ে কর্মরত ছিলেন।
তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম ও এক পুত্র এবং দুই কন্যাসন্তানের জনক দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো. হানিফউদ্দিন উদ্দিন মিয়া। পুত্র শরীফ হাসান সুজা দীর্ঘ ২৩ বছর সিমেন্স বাংলাদেশে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অন্যদিকে তার মেয়ে ডোরা শিরিন পেশায় একজন ডাক্তার। আর অপর মেয়ে নিতা শাহীন গৃহিণী। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের এই কৃতীসন্তান বাংলাদেশ অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স ও নিউমেরাল ম্যাথেমেটিকস থাকা সত্বেও শিল্প-সাহিত্যসহ আরও নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ। তিনি বাংলা ও ইংলিশ ছাড়াও উর্দু, আরবি, হিন্দি, জার্মান ও রাশিয়ান ভাষা জানতেন।
২০০৭ সালের ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়ার নাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত।’
মন্ত্রী ডাক অধিদপ্তর প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার মো: হানিফউদ্দিন মিয়া এর স্মরণে দশ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন।
অনলাইন নিউজ ডেস্ক / বিজয় টিভি