ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ‘কিশোর গ্যাং’এর সদস্যরা। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নারীদের উত্ত্যক্ত করা; এ ধরনের অপরাধে ‘কিশোর গ্যাং’এর নাম আসছে। এসব বাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সী।
গত এপ্রিল মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিশোর গ্যাংদের তৎপরতা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন সারাদেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন।
কিশোর গ্যাং সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলা শহরগুলোতেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা (পৃষ্ঠপোষকেরা)। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তথা নেপথ্যের শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
‘হিরোইজমের’ চিন্তাভাবনা থেকে কিশোরদের মধ্যে ‘গ্যাং’ কালচার শুরু হলেও তারা এখন ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার ফলে কিশোরেরা নিজেদের ‘পাওয়ারফুল’ (ক্ষমতাবান) মনে করে এবং সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে, তার ২৫টি কিশোর গ্যাং-সংশ্লিষ্ট। এর অর্থ হচ্ছে, বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজ এলাকায় প্রভাব বাড়াতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রোধে গত ২৩ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন থানার ওসিদের নির্দেশনা দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান। সেদিন ডিএমপির মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় তিনি বলেন, যে ওসির থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, গত ৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেন তাদের (কিশোর অপরাধী) মিলিয়ে ফেলা না হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা—এ ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো যেন রাখা হয়। মন্ত্রিসভার ঐ বৈঠকে কিশোর অপরাধীদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দের প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে শুধু জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে পড়ালেখার বাইরেও খেলাধুলা, নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউটিংয়ের মতো সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে; এমন অ্যাপগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া। পাড়া-মহল্লাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখা এবং কিশোর গ্যাংয়ের ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া। জুমার নামাজে খুতবায় কিশোর গ্যাংয়ের কুফল এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নিয়মিত বয়ানের পদক্ষেপ নেয়া। কিশোর সংশোধনাগারের পরিবেশ শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক হওয়া। সংশোধনাগারে যেন মানসিক নির্যাতন ও টর্চার সেলে পরিণত না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখা।
আরো বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেল রেস (গতির লড়াই) করে, এ বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিশোর গ্যাং সৃষ্টির কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গবেষণা করা প্রয়োজন।