সারাদেশের ন্যায় রাজবাড়ীতেও চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় রাজবাড়ীর জনজীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। একদিকে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে জেলার মানুষ অন্যদিকে নতুন করে প্রায় সব উপজেলাতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। এতে যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন।
জানা গেছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে খরায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যার ফলে নলকূপে (টিউবওয়েল) পানি উঠছে না। পানির অভাবে গৃহস্থালী কাজকর্ম যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি জমিতে সেচ দিতে পারছে না কৃষক। সেচের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ফসলাদি।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির তাপসী বিশ্বাসের ৬ সদস্যের পরিবার। নিজের নলকূপ থাকলেও বেশ কয়েকদিন ধরে তাতে পানি উঠছে না। ফলে সীমাহীন কষ্টে ভুগছেন তার পরিবারের সদস্যরা। একদিকে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ অন্যদিকে পানির জন্য হাহাকার। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রচণ্ড গরম। সবকিছু মিলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তার পরিবারের জীবনযাত্রা। পানির অভাব মেটাতে ছুটছেন প্রতিবেশীদের বাড়িতে। কিন্তু কোথাও মিলছে না পানি।
জানা গেছে, শুধু তাপসী বিশ্বাসের পরিবারই নয়। পানির জন্য এমন চিত্র রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির সাতটি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবারের। তীব্র তাপপ্রবাহ এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই ভোগান্তি বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
বালিয়াকান্দি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভৌগোলিক কারণে বৃহত্তর ফরিদপুরের মধ্যে বালিয়াকান্দি উপজেলাটি ভিন্ন। আশেপাশের তুলনায় এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ স্তর বেশ নিম্নমুখী। যে কারণে প্রতি বছর পানির স্তর ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি নিচে নেমে যাচ্ছে। বালিয়াকান্দিতে মোট পরিবারের সংখ্যা ৫০ হাজার। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ৫টি পরিবারের জন্য কমপক্ষে একটি নলকূপ থাকা জরুরি। সে অনুযায়ী বালিয়াকান্দিতে প্রয়োজন প্রায় ১০ হাজার নলকূপ। কিন্তু সরকারি ভাবে ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৬০টি সাবমারসিবল পাম্প ও ২০১৯ সাল থেকে ৫২০টি তারা টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।
আরও পড়ুন: বাগেরহাটে ট্রাকচাপায় ৩ ভ্যানযাত্রী নিহত
ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে সব বাসাবাড়িতে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে সেগুলোতেও এখন আর পানি ওঠছে না। পানি না ওঠার কারণ হিসেবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বলছে, বালিয়াকান্দিতে বর্ষা মৌসুমে পানির স্তর ১৫ থেকে ২২ ফুট নিচে চলে যায়। আর শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে সেটা নেমে দাঁড়ায় ৩২ ফুট নিচে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বসানো নলকূপগুলোর পাম্পিং ক্ষমতা ২০ থেকে ২৪ ফুট। যার কারণে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে পানি থাকে না। শুধুমাত্র সরকারিভাবে বসানো তারা ও সাবমারসিবল পাম্প দেওয়া নলকূপে পানি থাকে।
বালিয়াকান্দির সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা অনিক শিকদার, সবুজ শিকদার, নারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মিঠুন, রিয়াদসহ অনেকেই জানান, গত কয়েকদিন হলো বালিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্নস্থানে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে টিউবওয়েল পানি উঠছে না। বাড়ির গৃহস্থালি কাজ করার জন্য অন্য জায়গা থেকে পানি আনতে হচ্ছে। এতে করে ভোগান্তি বেড়েছে বাড়ির মা বোনদের।
নবাবপুর ইউনিয়নের মেছুয়াঘাটা এলাকার কৃষক আবদুল মান্নান জানান, পানি না ওঠায় তিনি মাঠে ফসল চাষ করতে পারছেন না।এখন পাট চাষের উপযুক্ত সময়। জমিতে সেচ দিয়ে পাটের চারা রোপণ করতে হবে। কিন্তু পানি না ওঠায় তিনি পাটের বীজ রোপণ করতে পারছেন না।
পানির এ সমস্যা শুধু বালিয়াকান্দিতেই নয়। রাজবাড়ী সদর, পাংশা, কালুখালীতেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই উপজেলার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। গত কয়েকদিন ধরে পানি ওঠা বন্ধ হয়েছে। তীব্র খরায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে পানি উঠছে না বলে জানান স্থানীয় অনেকেই। কিছু নলকূপে পানি উঠলেও পারিমাণে অনেক কম। সমস্যা বেশি সৃষ্টি হয়েছে পুকুর ও বিভিন্ন জলাশয় পানি শূন্য হয়ে যাবার কারণে। অনেক পরিবার পানির সমস্যা সমাধানে মোটর বসিয়েছে। সেখান থেকে পানি নিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে অন্য পরিবারগুলো। পানির সংকটে প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। স্যালো মেশিনেও পানি উঠছে না। ফলে পাটের জমিতে সেচ দিতে পারছে না কৃষক। অনেক জমির পাট পানির অভাবে মারা যাচ্ছে। অনেক কৃষক স্যালো মেশিনে পানি তুলতে ১২ ফুট গর্ত করেছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ ইউনিয়নের আটদাপনিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানে কোন নলকূপে পানি উঠছে না। অনেকে নলকূপের সাথে মোটর বসিয়েছে। তারপরও পানি উঠছে না।
আটদাপনিয়া গ্রামের গৃহবধূ মিতা বিশ্বাস বলেন, কয়েকদিন ধরে পানির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে টিউবওয়েলে পানি থাকছে না।
কালুখালি উপজেলার মদাপুর ইউনিয়নের দামকুদিয়া গ্রামেও একই চিত্র। গান্ধিমারা বাজারের পলাশ হোটেলের মালিক পলাশ প্রামানিক বলেন, এই বাজারের সবগুলো নলকূপ নষ্ট। কোনোটিতেই পানি ওঠে না। সব ব্যবসায়ী ও চায়ের দোকানদার বাড়ি থেকে পানি নিয়ে আসে বাজারে। আমার দোকানে মোটর বসানো আছে। তারপরও সকালে আর রাতে খুব অল্প পরিমাণে পানি ওঠে।
পাংশা উপজেলার সরিষা, বাবুপাড়া, কলিমহর, মৌরাট, পাট্টা ইউনিয়নেও চলছে পানির সংকট। পাশাপাশি এসব এলাকার চাষিরা পানির অভাবে পাটের জমিতে সেচ দিতে পারছে না। রোদে মাটি শুকিয়ে পাট মারা যাচ্ছে।
পাংশা উপজেলার কলিমহর ইউনিয়নের মিয়া পাড়ার বাসিন্দা শারমিন আক্তার লুবনা বলেন, কিছুদিন হলো টিউবওয়েল পানি নেই।একই টিউবওয়েলের লাইনের সঙ্গে মোটর সংযু্ক্ত করা থাকলেও সেখান থেকেও পানি উঠছে না। পরে টিউবওয়েলে মিস্ত্রি আনা হলে তারা জানায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
রাজবাড়ী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাকারিয়া বলেন, গ্রীষ্মকালে খরায় পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ফলে টিউবওয়েল থেকে পানি ওঠে না। আমাদের এ অঞ্চলে বেশিরভাগ পানির লেয়ার ২৫ ফুটের নিচে নেমে গেছে। ফলে এখন টিউবওয়েল ও চাপকল দিয়ে পানি উঠছে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে যারা সাবমারসিবল পাম্প অথবা তারা টিউবওয়েল বসিয়েছে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।