জয়পুরহাটে স্কুলছাত্র মোয়াজ্জিম হত্যা মামলার ফাঁসি দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি দেওয়ান বেদারুল ইসলামের বেদিনের বাসায় গিয়ে তার কাছে এক ব্যক্তি টাকা নিচ্ছেন এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফাঁসির আসামি দেওয়ান বেদারুল ইসলাম তার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শুক্রবারে (২৮ জুন) ভিডিও পোস্ট করেন।
দেওয়ান বেদারুল তার ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা ভিডিও’র ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘সাধু-সাবধান জয়পুরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সম্মানীয় পেশকার জনাব শাহীন আমার মামলার রায়ে ফাঁসির ভয় দেখিয়ে রায়ে খালাস করে দেবে বলে আমার বসার ঘর থেকে প্রত্যহারকৃত বিজ্ঞ বিচারক জনাব আব্বাস উদ্দিনের নাম করে টাকা নেয়ার ভিডিও ফুটেজ। তার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।’
ভিডিওটি শুক্রবারে ফেসবুকে আপলোডের পর শনিবার রাত ১০টা ২০ পর্যন্ত পর্যন্ত ৩৫টি কমেন্ট, ২১টা শেয়ার ও ১০ হাজার ৬০০ ভিউ হয়েছে। ওই ভিডিওর স্কিনে ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ লেখা রয়েছে। ৬ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, দেওয়ান বেদারুল ইসলামের বাসার একটি ঘরে একব্যক্তি গায়ে জ্যাকেট ও মাথা মাফলার পড়ে ঢোকেন। তাকে ঘরে বসিয়ে রেখে বেদারুল কিছুক্ষণের জন্য চলে যান। জ্যাকেট ও মাথায় মাফলার পরা ব্যক্তি ঘরের এদিক ওদিক তাকাতাকি করছিলেন। এরপর বেদারুল ইসলাম একটি লাল রঙের ব্যাগ নিয়ে ঘরে আসেন। বেদারুল লাল ব্যাগটি পাশের টেবিলের ওপর রাখেন। তখন ওই ব্যক্তি বেদারুলকে কিছু বলছিলেন। বেদারুল এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার উত্তর দিচ্ছিলেন। এরপর তাদের মধ্যে কিছু কথোপকথনের পর বেদারুল টেবিলের ওপর রাখা লাল ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে টাকার বান্ডিলগুলো বের করে ওই ব্যক্তির হাতে দেন। ওই ব্যক্তি টাকার বান্ডিলগুলো দেখে লাল ব্যাগটি চেয়ে নিয়ে সেই ব্যাগে টাকাগুলো ঢুকিয়ে নেন। এরপর তারা দুজন নিজেদের মধ্যে কিছু কথোপকথন করেন। এরপর আবার বেদারুল কয়েক সেকেন্ডের জন্য কক্ষ থেকে বাসার ভেতরে চলে যান।
এরপর তিনি আবারও কক্ষে ফিরে আসেন। এরই কিছুক্ষণ পর সেখানে গায়ে চাদর ও মাথায় কাপড় পরা এক নারী সেখানে আসেন। তাকে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছিল।
বেদারুলের বাসায় গিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নেয়া ব্যক্তিটিকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস, এম শাহিন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। ভিডিওতে টাকা নেয়া ব্যক্তিটি বেঞ্চ সহকারী এস,এম শাহিন নিজের বলে স্বীকারও করেছেন। তবে ভিডিওতে দেখা যাওয়া টাকা নেয়ার বিষয়টি ঘুষ নেয়ার ঘটনা নয় বলে তিনি দাবি করেছেন।
শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস, এম শাহিন বলেন, আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু বেদারুল ইসলাম। তিনি আমার বড় ভাই ও আমার কাছে কিছু টাকা নিয়েছিলেন। সেই টাকা তিনি আমাকে ফেরত দিয়েছেন। বেদারুলের মামলা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ছিল না। এর আগেও বেদারুল এরকম ভিডিও দিয়েছিল। বেদারুল কেমন মানুষ সেটি জয়পুরহাটের মানুষ জানে। মামলা খালাসের কথা বলে টাকা নেয়ার কথা সত্য নয়।
জয়পুরহাটের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারীর নাঈম হোসাইনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৩ জুন আদালতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ওইদিনই বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইন বাদী হয়ে আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী সাক্কু ও তার মোহরী প্রিতমের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আমলী আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। এ মামলায় আইনজীবী ও তার মোহরী উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এ ঘটনায় সমিতির সদস্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলামের সঙ্গে দেখা করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করেন। কিন্তু সন্তোষজনক সমাধান হয়নি।
এরপর গত ২৪ জুন থেকে আইনজীবীরা অনির্দিষ্টকালে জন্য জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলামের আদালত বর্জন করেছেন। এখনো বিষয়টি সুরাহা হয়নি। আইনজীবীদের দাবি- কয়েকটি আদালতের বেঞ্চ সহকারী ঘুষ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। ঘুষ না পেলে তারা হয়রানি করেন।
এরই মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস, এম শাহিন এক ফাঁসির আসামি দেওয়ান বেদারুল ইসলাম বেদিনের বাসায় গিয় টাকা নেয়ায় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বেঞ্চ সহকারীরা ঘুষ নেন আইনজীবীদের এমন অভিযোগ অনেকটায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছ বলে মনে করছেন অনেকেই।
জয়পুরহাট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহনূর রহমান শাহীন বলেন, একটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির কাছে থেকে টাকা নেয়ার দৃশ্য সম্বলিত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও আমাকে একজন আইনজীবী দেখিয়েছেন। টাকা নেয়া ব্যক্তিটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী শাহিন বলে আমার মনে হয়েছে। হত্যা মামলার আসামির সঙ্গে আদালতের বেঞ্চ সহকারী আর্থিক লেনদের সম্পর্ক থাকা সমীচীন নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর এটি তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মনে করছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেদারুল ইসলাম বেদিন জয়পুরহাট সদর উপজেলার পাঁচুর চক উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মোয়াজ্জিম হোসেন হত্যা মামলার আসামি। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্বাস উদ্দিন বেদারুল ইসলামসহ ১১ জন আসামির ফাঁসির আদেশ দেন। একই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেকের অর্ধ লক্ষ টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
ওই মামলার রায় ঘোষণার পাঁচ দিনের মাথায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তরা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্বাস উদ্দিনের হাউজিং এস্টেটের ভাড়া বাসার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢোকেন। তারা অতিরিক্ত দায়রা জজ মো. আব্বাস উদ্দিনকে ফাঁসি দেয়ার হুমকি দেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা তার বাসা থেকে পাঁচ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা চুরি করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নিজেই বাদী হয়ে জয়পুরহাট সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই ঘটনার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিচারক মো. আব্বাস উদ্দিন প্রত্যাহার করা হয়।