মরণব্যাধি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে শুধু রোগীকে নয়, লড়াই করতে হয় রোগীর পুরো পরিবারকে। অসংখ্য ওষুধ, বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি আর ক্যান্সারের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার জাঁতাকলে এই মৃত্যুমুখী রোগীদের শেষ সঙ্গী অসহায়তা। কোন চিকিৎসা পদ্ধতি সুরাহা দিতে পারে, কোন পথে যাওয়া ঠিক সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিকতা প্রায় কারোরই থাকে না। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
যত দিন যাচ্ছে ক্যান্সার চিকিৎসায় নিত্য নতুন প্রযুক্তি আসছে। সেরকমই একটি আধুনিক চিকিৎসা করা হচ্ছে চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালে। নাম ‘প্রোটন বিম থেরাপি’।
সম্প্রতি এই অত্যাধুনিক চিকিৎসায় ব্রেন টিউমার মুক্ত হয়েছে হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা ১১ বছরের একটি শিশু। শুনতে যতটা সহজ, ট্রিটমেন্ট ততটা সহজ নয় ঠিকই, তবে অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। হায়দ্রাবাদের শিশুটিকে প্রায় একমাস ধরে প্রোটন থেরাপি দেওয়া হয়েছে। শুধু এই শিশু নয়, এমন রোগীর সংখ্যা চেন্নাইয়ের অ্যাপোলোতে অনেক। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও অন্য দেশ থেকে এখানে রোগীরা আসছেন প্রোটন থেরাপি দিতে। কী এই বিশেষ পদ্ধতি?
প্রোটন থেরাপি কেন ভালো?
প্রোটন থেরাপি বা প্রোটন বিম থেরাপি এক প্রকার রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট। তবে সাধারণ রেডিয়েশনের চেয়ে উচ্চমানের। এই থেরাপি দিয়ে টিউমার পুরোপুরি শিকড় থেকে নির্মূল করা সম্ভব। সাধারণ রেডিয়েশনের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, প্রোটন থেরাপি দিয়ে আরও বেশি করে টার্গেট স্থির করে থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অর্থাৎ আরও নির্দিষ্ট করে শুধু ক্যান্সার সেলেই এই থেরাপি প্রয়োগ করা সম্ভব। ফলে আক্রান্ত জায়গায় পুরো এনার্জি পৌঁছতে পারে এবং দ্রুত কাজ হয়। এই থেরাপি ক্যান্সার কোষের বা টিউমারের ডিএনএ পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়, সঙ্গে আশপাশে আরও হেলদি টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে। আর টিউমার কোষকে এমনভাবে নষ্ট করে যে তা পুনরায় নিজ থেকে ঠিক হয়ে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে না। ফলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, সাধারণ রেডিয়েশন হলো এক প্রকার এক্স-রে বা হাই এনার্জি বা মেগা ফোল্টেজ এক্সরে। ফলে এই উচ্চমাত্রায় রে যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন ক্যান্সার সেলের সঙ্গে সারা শরীরে তার প্রভাব ফেলে। অন্য হেলদি অঙ্গ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু প্রোটন হলো পজিটিভ এনার্জি পার্টিকেলস। এই বৈশিষ্ট্য থাকার জন্য প্রোটন শরীরে প্রবেশ করার পর একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ক্যান্সার সেলের বাইরে অন্যান্য অঙ্গ তাই এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সাইড এফেক্ট খুবই কম।
কোন ক্যান্সারে সাফল্য?
দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যে যে ক্যান্সারে প্রোটন বিম থেরাপি সাড়া ফেলেছে তা হলো– শিশুদের ক্যান্সার বা পেডিয়াট্রিক টিউমার, ব্রেন টিউমার, স্পাইন্যাল টিউমার, স্কাল বা করোটিতে টিউমার আর যাদের একাধিকবার ক্যান্সার বা টিউমার ফিরে এসেছে এবং একবার সাধারণ রেডিয়েশন দিয়ে কাজ না হলে সেসব ক্ষেত্রে প্রোটন থেরাপি কার্যকর।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে যখন সার্জারি বা সাধারণ রেডিয়েশন দেওয়া যায় না তখনো এই প্রোটন থেরাপি দেওয়া হয়। যেমন– করোটিতে টিউমারের ক্ষেত্রে।
এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে যে ধরনের ক্যান্সারগুলো আজকাল বেশি দেখা যাচ্ছে সেসব ক্ষেত্রেও প্রোটন থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। যেমন– প্রস্টেট ক্যান্সার, কিছু ধরনের স্তন ও ফুসফুস ক্যান্সার, হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার, কিছু ধরনের লিভার ক্যান্সার, প্যাংক্রিয়াটিস ক্যান্সার, অ্যান্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার, সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার এমনকি কিছু ধরনের চোখের ক্যান্সারেও কার্যকর।
কিছু সীমাবদ্ধতা
যেহেতু এই প্রোটন থেরাপির জন্য খুব উচ্চমানের পরিকাঠামো দরকার তাই প্রায় কোনো হাসপাতালেই এখনো এই চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আরও একটা ব্যাপার হলো ক্যান্সারের ধরন, কোন স্টেজ এসব বিবেচনা করে তবেই এই থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। যে যে ক্ষেত্রে সাধারণ রেডিয়েশনে কাজ হয়, সেক্ষেত্রে প্রোটন থেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেটা চিকিৎসকরা অনেক কিছু দেখে তবেই বিবেচনা করেন। এই চিকিৎসার খরচও অনেক। তবে যখন সব ট্রিটমেন্টই প্রায় নিরাশ করে, তখন প্রয়োজনে প্রোটন থেরাপির ট্রিটমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য গবেষণা চলছে, তবুও ক্যান্সারকে পুরোপুরি করায়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে নতুন কিছু পথের সন্ধান পেলে যেন হালে পানি পাওয়া যায়। ক্যান্সারের চিকিৎসায় এমনই এক আশ্বাসের কথা বললেন চেন্নাই অ্যাপোলোর প্রোটন সেন্টারের রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট ডা. শ্রীনিবাস চিলুকুরি।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, আজকের দিনে ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রোটন থেরাপি নিঃসন্দেহে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বিশেষ করে, শিশুদের ক্যান্সার ও মাথার খুলির ক্যান্সারের চিকিৎসায় যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, ফলে নানা রকমের চিকিৎসা করেও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সফল হতে পারি না। সেগুলো প্রোটন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা এখন অনেকটাই সহজ হয়েছে। তবে প্রোটন থেরাপি এখন খরচসাপেক্ষ, তাই অনেকেরই নাগালের বাইরে। ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রোটন থেরাপি সেন্টারের সূচনা হলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি উপকৃত হবে। খরচও আয়ত্তে আসবে।