আজ ৫ আগস্ট, স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে মুক্তির দিন।
দীর্ঘ ষোল বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার দিন। ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত সেই বিজয়ের দিন ফিরে এসেছে। গত বছর আজকের এই দিনে আপামর ছাত্র-জনতা বিজয়োল্লাসে জাতীয় পতাকা হাতে ঘর ছেড়ে পথে নেমে এসেছিলেন।
বেলা ৩টা, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সেনাপ্রধানের ভাষণের অপেক্ষা না করে মুক্তির আনন্দে বেরিয়ে পড়ে দেশের সর্বশ্রেণির মানুষ। প্রতিটি গলির মুখ থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল। ছোট্ট শিশু। কলেজ ড্রেস পরা বালক-বালিকা। কপালে পতাকা বাঁধা তরুণ। মসজিদের ইমাম। পাড়ার সবজি বিক্রেতা। সাদা চুলে মেহেদি পরা বৃদ্ধ। একে একে সেই মিছিলে শরিক হচ্ছেন সবাই। গন্তব্য রাজপথ। সবার মুখে বিজয়ের স্লোগান! দেশমাতৃকার নাম বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!
দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ২০২৪ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। ’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাণীতে বলেছেন, ‘জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো- একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। ’
ছাত্র-জনতার রাজপথে নেমে আসার এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শুরুটা হয়েছিল ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে। তারা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে স্লোগান তোলে- কোটা না মেধা! মেধা, মেধা! মেধাবী শিক্ষার্থীদের সেই স্লোগান ধীরে ধীরে এক দফায় পরিণত হয়। সবার মুখে একই কথা- এক দফা, এক দাবি/ হাসিনা তুই কবে যাবি!
জুলাই হত্যাকাণ্ড সামরিক বাহিনীতেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ৩ আগস্ট ঢাকায় সেনা সদরে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ (সেনা কর্মকর্তাদের মতবিনিময়) হয়। ওই মতবিনিময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনেন। ওই দিন সেনা কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তারা ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালাতে পারবেন না। মতবিনিময় অনুষ্ঠানে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যে কোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন ৪ আগস্ট সারা দেশ থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। এক দফা দাবি আদায়ে ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির যে ঘোষণা দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তা এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ব্যারিকেড দেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সেই ব্যারিকেড ভেঙে ছাত্র-জনতা এগোতে থাকেন। বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ ভঙ্গ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেন তারা। একপর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। দুপুরে গণমাধ্যমে খবর পাঠানো হয়, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান।
সেনাবাহিনী সূত্রে বিবিসি জানতে পেরেছে, ৫ আগস্ট বেলা ১১টার মধ্যেই শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে গেছেন। হাসিনার পলায়নের খবরে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে দেশের মানুষ। শুরু হয়ে যায় ‘পলাইছে রে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে’ স্লোগান। লাখো বিক্ষুব্ধ জনতা ততক্ষণে পৌঁছে যায় গণভবনে। সেখানে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে সংগ্রামী জনতা। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় উন্মত্ত জনতার আনন্দোচ্ছ্বাস। গোটা বাংলাদেশ পরিণত হয় এক উৎসবের নগরীতে।