বোমাটা ফাটিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। টুইট করে তিনি জানিয়েছিলেন, ”আমি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জানতে চেয়েছি, কেন আনন্দবাজারের সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিশ নোটিশ পাঠিয়েছে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো আলোচনা চলতে পারে না। এটা গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড এবং সংবিধান স্বীকৃত।” তারপরেই রটতে শুরু করে ওই সম্পাদককে ছয় ঘণ্টা ধরে থানায় বসিয়ে রেখে জেরা করা হয়েছে। তবে পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় একটা চিঠি দিয়ে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তিনি প্রবীণ নাগরিক। করোনার সময়ে তাঁকে প্রকাশ্য স্থানে যেতে চিকিৎসকরা মানা করে দিয়েছেন।
অনির্বাণ এটাও জানিয়েছিলেন, তিনি হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেছেন। চিঠির সঙ্গে চিকিৎসকের সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। সেখানে চিকিৎসক বলেছেন, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় হাইপারটেনশনের রোগী। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁর প্রকাশ্য স্থানে যাওয়া উচিত হবে না। তারপর নাকি পুলিশ আর কিছু বলেনি।
সূত্র জানাচ্ছে, গত এপ্রিলে বাঙুর হাসপাতাল নিয়ে একটি খবরকে কেন্দ্র করে করা এফআইআরের ভিত্তিতে তাঁকে ডাকা হয়েছিল।
অনির্বাণ আর আনন্দবাজারের সম্পাদক নেই। রোববার তাঁর জায়গায় ঈশানী দত্ত রায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কোনো একটি সংবাদপত্রে কাকে সম্পাদক করা হবে, সেটা পুরোপুরি ওই সংস্থার সিদ্ধান্ত। প্রশ্নটা উঠেছে, আনন্দবাজারের মতো সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকের সম্পাদককে একটা খবরের ভিত্তিতে থানায় ডেকে পাঠানোর কারণে৷ অভিযোগ করার ৫০ দিন পর কেন ডাকা হলো সেই প্রশ্নও উঠেছে৷ আরো প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি করোনা ও আমফান পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চলছে ?
আনন্দবাজারের ঘটনাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। খবর নিয়ে এরকম আরেকটি অভিয়োগ করা হয়েছিল একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের বিরুদ্ধে। সেখানে অবশ্য সংবাদ বিভাগের প্রধান ও সাংবাদিককে থানায় যেতে হয়েছে এবং জেরার মুখে পড়তে হয়েছে।
সেই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, প্রকাশিত খবর শাসকের পছন্দ হলেই কাগজে বা চ্যানেলে রাজ্য সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনার আগের সময়ে একটি প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন কয়েক মাস বন্ধ ছিল। সূত্র জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনও বন্ধ ছিল। তারপর তা চালু হয়। আবার সেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। আরেকটি ছোট টিভি চ্যানেল দেখানো নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেখানেও প্রশ্ন উঠেছে, সরকার বিরোধী খবর করার জন্যই কি তাদের এই অবস্থা?
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ”সরকারের অপছন্দ হলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা আগেও ছিল। আগে আমরা দেখেছি, বামেদের কঠোর সমালোচক বা বিরোধী কাগজগুলো বিজ্ঞাপন অনেক কম পেতো, কিন্তু একেবারেই পেতো না এমন নয়। এখন দেখছি, সরকারের বিরোধিতা করলে বিজ্ঞাপন পুরো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্য রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় স্তরেও এটা হচ্ছে বলে শুনেছি। বিজ্ঞাপন তো জনগণের পয়সা থেকে দেওয়া হয়। সেখানে একটা নীতি থাকা দরকার। প্রচারের সংখ্যার মতো কিছু মাপদণ্ডের ভিত্তিতে তা ঠিক করা উচিত।”
শুভাশিস মৈত্রের প্রশ্ন, ”কেন বিজ্ঞাপন শাসক দলের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করবে? একটা নিয়ম থাক। তার ভিত্তিতে কেন্দ্র ও সব রাজ্য সরকারগুলি বিজ্ঞাপন দিক। আর এই যে থানায় ডেকে পাঠানো, সেটাও সংবাজদপত্রকে শাসন করার রকমফের।”
সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ”আসলে শাসকের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বাড়লে প্রথমে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়। তারপর সংবাদমাধ্য়মের। সংবাদমাধ্যম লোকের কাছে বার্তা নিয়ে যায়। সরকার চায়, শুধু তাঁদের কথাই লোকের কাছে যাক। বিরোধীদের কথা নয়। এতে কখনোই শেষরক্ষা হয় না।”
মহম্মদ সেলিমের দাবি, ”দেশের ক্ষেত্রে আমরা কয়েক বছর ধরে দেখছি, সংবাদমাধ্য়মকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রয়াস হচ্ছে। আগে তো সম্পাদকদের রাজ্যসভার এমপি করা হয়েছে। এখন এমন একজন সম্পাদককে নোটিশ দেওয়া হলো, যাঁর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। সেই সংবাদপত্র কিছুটা মানুষের কথা বলেছে। তাঁকে থানায় ডাকা মানে চাপ দেওয়ার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।”
সূত্র: ডয়েচে ভেলে