বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য আগামী ১১ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
কার্যতালিকায় ২৭ নম্বর ক্রমিকে থাকা ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদালতে আবেদন করেন। প্রধান বিচারপতি আজ না থাকায় শুনানির জন্য আগামী ১০ জুলাই দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।
এর আগে বেশ কয়েকবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন কার্যতালিকায় এলেও শুনানি হয়নি।
গত বছরের ২৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ ৬ জন বিচারপতি শুনতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন আপিল বিভাগ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এর আগে গত ১৬ নভেম্বর বহুল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন ৬ জন বিচারপতির বেঞ্চ শুনতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে আদেশের জন্য ওই দিন ধার্য করা হয়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির বেঞ্চ এই আদেশের জন্য এ দিন ধার্য করেন।
সেদিন ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ছিল। শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সময় আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি সময় আবেদনের সময় প্রশ্ন উপস্থাপন করে বলেন, আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আপিল বিভাগে ৬ জন বিচারপতি রয়েছে। ৬ জন বিচারপতি রিভিউ শুনতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্ন উপস্থাপন করেন তিনি।
মনজিল মোরসেদ বলেন, দীর্ঘদিনের কাস্টমস অনুযায়ী কোন রায়ের রিভিউ সমসংখ্যক বিচারপতি বা বেশি বিচারপতির বেঞ্চে শুনে থাকেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি যে প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন আমরা এখনই এ বিষয়ে সিনিয়রদের আইনজীবীদের মতামত নিতে চাই। এরপর আপিল বিভাগে একে একে কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী মতামত তুলে ধরেন।
এর মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি, প্রবীর নিয়োগী, মুরাদ রেজা, তানজীবুল আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ তারা সবাই আদালতকে বলেন, এখন আপিল বিভাগে ৬ জন বিচারপতি রয়েছেন। ৬ জন বিচারপতি নিয়েই এখন আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ। তাই ৬ জন বিচারপতির যোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনতে বাধা নেই।
তবে এর বিপক্ষে মত দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সমসংখ্যক বিচারপতি বা তার বেশি বিচারপতির বেঞ্চে রিভিউটা শুনানি হওয়াই শ্রেয়। ৬ বিচারপতির বেঞ্চে এই রিভিউ শুনানি হলে নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে। মতামত নেওয়া শেষে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে আদেশের জন্য নতুন দিন ধার্য করেন।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়।
আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি দেখিয়ে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চাওয়া হয়।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। ৮মে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে ১১ দিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন।
অপর নয় অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
২০১৬ সালের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
আদালত রায়ে আরও বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সাংসদরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সাংসদদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
রায়ে আরও বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।
সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন।