মৌসুমী বায়ূর প্রভাবে উজানের ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি ১০ দিন ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে পানিবন্দি ৫টিউপজেলার প্রায় ৩৪ টি ইউনিয়নের ১ লাখেরও বেশি মানুষ। বন্যার পানিতে জেলায় সাড়ে ৩ শত কিলোমিটার পাকা-রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বন্ধি মানুষেরা সাপ ও পোকা মাকড়ের ভয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে।
পানিবন্দি অধিকাংশ মানুষেরা পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্র, উচু রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের উপরে। এসব মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনা খাবার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে বেশী নারীরা।
বাড়ি-ঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সহায় সম্বল হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে বন্যাকবলিত মানুষেরা। করোনার কারনে কাজকর্ম তেমন না থাকায় এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবন-যাপন করছে বান-ভাসি মানুষেরা। দীর্ঘ সময় পানিতে অবস্থান করায় হাত-পায়ে ঘাসহ অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন পানি বাহিত রোগে। তলিয়ে গেছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ কাঁচা, পাকা সড়ক, রোপা আমনসহ সবজিক্ষেত।
সেই সাথে গো-চরণ ভুমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খামারীরা অধিক মূল্যে খড় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পানিবন্দি মানুষের মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা না পাওয়ার অভিযোগ বানভাসি মানুষের।
জেলা ত্রান ও পুর্নবাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ৫টি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদের মধ্যে সদর উপজেলার
৮টি, কাজিপুরের ৯টি, বেলকুচিতে ৬ টি, শাহজাপুরে ৪ ও চৌহালীতে ৭ টি ইউনিয়নে প্রায় ১ লাখ মানুষ পানি বন্ধি হয়েছে পড়েছে। পানি বন্ধিদের ৩৮২টি ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যার্তদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে ১৩৯ টি আশ্রয়কেন্দ্র। তলিয়ে গেছে এসব অঞ্চলের সাড়ে ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর ফসলি জমি। নদীতে বিলীন হয়েছে প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়ি।
শহর রক্ষা হার্ড পয়েন্টের ৩ নং বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা মাজেদা বেগম (৫৫) বলেন, অন্ধ এক ছেলে আর বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। বন্যার পানিতে বাড়ি-ঘর তলিয়ে যাওয়ায় গরু বাছুর নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। টিন কেনার সামর্থ নাই। তাই তাবু টানিয়ে মানুষ ও গরু এক সাথে থাকচ্ছি। এক বেলা খাই, আরেক বেলা না খেয়ে থাকি। কেউ আমাদের খোজ খবর নেয় না। ফলে আমরা অসহায় ভাবে জীবন যাপন করছি।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষেরা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া হালিমা খাতুন, শাহানা খাতুন, আলম বয়াতি, মোমেনা খাতুন, মাহেলা বেগম, বুলু খাতুন, মাজেদা বেগম, আব্দুর রশিদ, জবেদা বেগম ও সাহেব আলী জানান, বন্যায় আমাদের সব কিছু ভেসে গেছে। আমরা অসহায় অবস্থায় বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়ে দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছি। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবী, এই অসহায় মুহুর্তে আমাদের পাশে এসে দাড়াতে। খাদ্য সহায়তা দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে। তা না হলে আমরা রোগে শোকে ও ক্ষুধায় মারা যাব।
সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা বলেন, এখনও সরকারিভাবে কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বরাদ্দ পেলে বন্যাত্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এছাড়া বাঁধ এলাকায় যে সব সমস্যা আছে তা ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবু হানিফ জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলের ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অসময়ের বন্যায় ৫টি উপজেলার ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এদের মধ্যে রোপা আমন-৫৭০৫, সব্জী-২৫৫, বোনা আমন-৯৬৫, আখ-২৮০, বীজ তলা-১০১ ও কলা-১৮ হেক্টর ফসল নিম্নজীত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, উজানের ঢলে ৫টি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার কমে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর মেঘাই ঘাট পয়েন্টেও ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে যমুনার পানি। জেলার চৌহালী ও কাজিপুর উপজেলায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জিও ব্যাগ ভেলে ভাঙন ঠেকানোর চেস্টা চলছে বলে এই কর্মকতা জানান।
সিরাজগঞ্জ এলজিইডি’র সিনিয়র প্রকৌশরী মো: বদরুজ্জোহা জানান, বন্যায় জেলার প্রায় সাড়ে ৩ শত কিলোমিটার পাকা-রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত রাস্তার ক্ষতির খোজ পাওয়া যায়নি। রাস্তা থেকে পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমান জানা যাবে ।
জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মাদ জানান, বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এরই মধ্যে উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ৭২১ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লক্ষ টাকা মজুদ রয়েছে।
তিনি আরও জানান, বন্যার্তদের জন্য ১৩৯ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। ভেঙ্গে যাওয়া ও ঝুঁজিপূর্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোতে মেরামতের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুর্গত ইউনিয়ন পর্যায়ে মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।